এক ঠান্ডা বিকেলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের সিয়াং নদীর কাছে জড়ো হয়েছিলেন একদল বিক্ষোভকারী। গত মাসের ওই বিক্ষোভ থেকে সরকারবিরোধী নানা স্লোগান দিচ্ছিলেন তাঁরা। পারং গ্রামের এই আন্দোলনকারীরা আওয়াজ তোলেন, ‘আমাদের মা সিয়াংয়ের ওপর কোনো বাঁধ নয়। শান্ত পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া সিয়াং নদী শতকের পর শতক ধরে এই অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্র হিসেবে বিবেচিত। এই অঞ্চলের কৃষিনির্ভর মানুষের জীবিকা মূলত এই নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল।
সিয়াং নদীর উপকূলে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীদের একজন স্থানীয় আদি উপজাতি সম্প্রদায়ের সদস্য গেগং জিজং। সেদিন ঐতিহ্যগতভাবে তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে পূজনীয় নদীটি রক্ষার জন্য দাঁড়াতে হয়েছিল তাঁকে। কেননা, এই নদী এবং তার ওপর নির্ভরশীল তাঁদের জীবিকা এখন হুমকির মুখে। ভারত সরকার সেখানে দেশটির সবচেয়ে বড় বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ায় এই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
চীনের তিব্বতের কৈলাস পর্বতের কাছে উৎপন্ন সিয়াং নদী সেখানে ইয়ারলুং জাংবো নামে পরিচিত। এরপর এটি ভারতের অরুণাচল প্রদেশে ঢোকে এবং প্রশস্ত হয়। দেশটির বেশির ভাগ অংশে এটি ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত। পরে এ নদী বাংলাদেশ হয়ে পতিত হয় বঙ্গোপসাগরে। তিব্বতের মেডগ কাউন্টিতে যেখানে নদীটি ভারতে ঢুকেছে তার ঠিক আগেই বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করেছে বেইজিং। ভারতও তাদের অংশে এ নদীতে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।
বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, হিমালয় এলাকার পানির ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় দুই পরাশক্তির এ লড়াইয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ।
২০২০ সালে বাঁধ নির্মাণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় চীন। পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি বিশ্বের বৃহৎ ‘থ্রি গর্জেস বাঁধ’-এর চেয়ে বড় হবে। এটি নির্মাণে খরচ হতে পারে ১৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বছরে ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে এখান থেকে।
অন্যদিকে ভারতও বসে নেই। তারা বেইজিংয়ের ঘোষণার পর থেকে ‘চীনা প্রকল্পের প্রতিকূল প্রভাব এড়াতে’ পাল্টা বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা শুরু করে। দেশটি সম্প্রতি ‘সিয়াং আপার মাল্টিপারপাস প্রজেক্ট’ নামে একটি বাঁধ নির্মাণের সম্ভাব্যতা জরিপ করছে। পুরো প্রকল্পে খরচ হবে ১৩ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ বাঁধ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট।
বাঁধ নির্মাণে বেইজিং একেবারে ভারতের সীমান্তের যে কৌশলগত জায়গা বেছে নিয়েছে তাতে দিল্লি বেশ উদ্বিগ্ন। দিল্লির জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সহেলি চট্টরাজ বলেন, চীন ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ বাঁধটিকে কার্ড হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পাবে।
তার সঙ্গে একমত দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক বিআর দীপক। তিনি বলেন, চীন কখন পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মতো নিম্ন নদী তীরবর্তী দেশ সব সময় ভয়ে থাকে বিশেষ করে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঁধ নির্মাণ নিয়ে চীন-ভারতের এ টানাপড়েনে সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে।
ঢাকাভিত্তিক সংস্থা রিভাররাইনের সাধারণ সম্পাদক শেখ রোকন বলেন, এ নদী বাৎসরিক বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশের বেশি পানি সরবরাহ করে। যদিও ব্রহ্মপুত্রের মাত্র ৮ শতাংশ পড়েছে এ দেশে। চীন ও ভারতের এ বাঁধের বদলে বাঁধ নির্মাণ প্রতিযোগিতায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ।
গত এক দশক ধরে এ বিষয়গুলো নিয়ে শঙ্কিত ঢাকাভিত্তিক এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা খান। তিনি বলেন, কোনো তথ্যে আমাদের প্রবেশাধিকার নেই। আমাদের যৌথ ও বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন এবং তারপর সামাজিক ও দুর্যোগ প্রভাব মূল্যায়ন প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের কিছুই হয়নি।
ব্রহ্মপুত্রের তীরে বসবাস করা লাখ লাখ বাসিন্দা সরাসরি এ নদী থেকে উপকৃত হয়। খান বলেন, যদি এ নদীর প্রবাহে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটে তাহলে নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন বৃদ্ধি পাবে এবং ভূমি উদ্ধারের সুযোগ ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
চীন ও ভারতের বাঁধ নিয়ে ‘অপেক্ষা করা আর দেখার’ নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে বলে মত রোকনের। তার মতে, আমাদের এ নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ব্রহ্মপুত্রের আলোচনা কেবল বাংলাদেশ ও ভারত, অথবা ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হওয়া উচিত নয়; এটি একটি অববাহিকা-ব্যাপী আলোচনা হওয়া উচিত।
ভারত
চীন
হিমালয়ের পানি
