ব্যাটারিচালিত যানবাহন বন্ধে হাইকোর্টের আদেশ প্রত্যাহার করাসহ ১২ দফা দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে গণঅবস্থান কর্মসূচি পালন করতে জড়ো হয়েছেন হাজারো ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক। ফলে পল্টন-প্রেস ক্লাব ও হাইকোর্ট এলাকার সড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন এই পথে চলাচলকারীরা যাত্রীরা। পাশাপাশি এর জেরে বিভিন্ন রাস্তায় দেখা দিয়েছে তীব্র যানজনটেরও।
রোববার (২৪ নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টায় রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে এ কর্মসূচি শুরু করেন তারা। চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কামরাঙ্গীরচর, সেকশন, হাজারিবাগ ও সেকশন এলাকা থেকে এসেছেন। টিটাগাং রোড এলাকা থেকেও আরও রিকশাচালক আসছেন।
আরও পড়ুন— মহাখালীতে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের সেনাবাহিনীর ধাওয়া
এদিকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী, শাহবাগ, প্রেসক্লাব, সায়েন্সল্যাব, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরসহ বেশ কয়েকটি স্থানে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা সড়ক অবরোধ করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। ফলে ওই সব সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
তাদের ১২ দফা দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্যাটারিচালিত যানবাহন বন্ধে হাইকোর্টের আদেশ প্রত্যাহার, বিআরটিএ লাইসেন্স প্রদান, দেশের সড়ক উপযোগী নকশায় আধুনিকায়নসহ ব্যাটারিচালিত যানবাহনের যৌক্তিক রুট পারমিট দেওয়া, ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচলে নীতিমালা প্রণয়ন, শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সড়ক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা কমিটি গঠন, সড়কের লেন পদ্ধতি সচল ও সার্ভিস লেন নির্মাণ।
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত গণঅবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন রিকশাচালক শ্রমিকরা। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী রিকশাচালকদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে গণসংগীত পরিবেশন করছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা বিশাল একটি মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট মাজার মোড় ও কদম ফোয়ারা হয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আসেন। এ সময় তারা ‘ব্যাটারিচালিত যানবাহন বন্ধে হাইকোর্টের আদেশ প্রত্যাহার করতে হবে’ স্লোগান দিতে থাকেন। পরে প্রেস ক্লাবের সামনে এসে তারা রাস্তায় বসে পড়েন।
প্রেস ক্লাবের সামনে একটি পিকাপ ভ্যানে লাল ব্যানারে সমাবেশ মঞ্চের আয়োজন করেছে রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়ন। মঞ্চে ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য রাখছেন।
আরও পড়ুন— পুলিশ-অটোরিকশা চালকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, বন্ধ রেল যোগাযোগ
সকালে যাত্রাবাড়ী মোড়ে অবস্থান নেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। তবে হঠাৎ লাঠি নিয়ে একদল লোক তাদের ধাওয়া করে। পথচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে রিকশাচলকরা প্রতিরোধ করেন। চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া।
এর আগে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশকে থানার সামনে অবস্থান নিয়ে থাকতে দেখা গেছে।
মফিজুল ইসলাম নামে এক চালক বলেন, আমরা নিয়ম মেনেই ঢাকায় অটো চালাতে চাই। এজন্য এখানে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাদের প্রতিনিধিদল যাত্রাবাড়ী থানায় গেছে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে। এরই মাঝে কিছু লোক এসে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
সাকিব মিয়া নামে এক ব্যাটারিচালিত রিকশাচলক বলেন, ঋণ করে অটোরিকশা কিনছি। এখন যদি বন্ধ করে দেয় তাহলে আমাদের পরিবারসহ না খেয়ে থাকতে হবে। সরকার যদি বন্ধ করতে চায় তাহলে আমদানি বন্ধ করে দিতে পারে। আমরা চাচ্ছি, হাইকোর্টের আদেশ প্রত্যাহার করে অটোরিকশা চালাচলের অনুমতি দেওয়া হোক।
মোহাম্মদপুরেও সকাল থেকে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। ফরে সড়কে যান চলাচল ব্যহত হয়।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান বলেন, হঠাৎ সকাল সাড়ে ১০টা দিকে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ চার রাস্তার মোড় ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় অটোরিকশা চালকরা সড়ক অবরোধ করেন। এতে সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
আরও পড়ুন— রিকশাচালকদের অবরোধে বন্ধ ট্রেন, রাজধানীজুড়ে যানজট
এর আগে গতকাল (২৩ নভেম্বর) পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস তাদের দাবিগুলো জানান। ইউনিয়নের অন্যান্য দাবিগুলো হচ্ছে— দেশের সড়ক উপযোগী নকশায় আধুনিকায়নসহ ব্যাটারিচালিত যানবাহনের বিআরটিএ লাইসেন্স ও যৌক্তিক রুট পারমিট দিতে হবে; চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করতে হবে; ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচলে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে; শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সড়ক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা কমিটি গঠন করতে হবে; সড়কের লেন পদ্ধতি সচল ও সার্ভিস লেন নির্মাণ করতে হবে; আন্দোলনে আটক ও গ্রেপ্তারকৃতদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে; ব্যাটারিচালিত যানবাহনকে গণপরিবহন ও শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে; জব্দ করা সব ব্যাটারিচালিত যানবাহন ও ব্যাটারি মালিকের কাছে হস্তান্তর ও নিলামকৃত ব্যাটারির মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে; চার্জিং স্টেশন নির্মাণ করতে হবে; মানবিক বিবেচনায় ব্যাটারিচালিত যানবাহনের পুঁজিকে নিরাপদ করে পর্যায়ক্রমে প্যাডেলচালিত বাহনের শ্রম থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হবে এবং শ্রমিকদের ওপর সব জুলুম-নির্যাতন-চাঁদাবাজি-হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলন আব্দুল কুদ্দুস বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে সৃষ্ট যানজটের দায় নগর পরিকল্পনাকারীদের না দিয়ে সব সময় দায় এড়াতে এ দেশের গরিব-মেহনতি মানুষের ঘাড়ে চাপানো হয়। একটি আদর্শ নগরে ২৫ শতাংশ সড়ক থাকতে হয়, কিন্তু ঢাকা মহানগরীতে আছে মাত্র ৮ শতাংশ। যার ৭৫ শতাংশই দখল করে আছে ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ি। ফলে নগরীর যানজটের প্রধান কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও ব্যক্তিগত গাড়ি। সরকার যানজট নিরসনে পরিকল্পিত নগরায়ণ ও ব্যক্তিগত গাড়ি অনুৎসাহিত না করে উপরন্তু গরিবের বাহন বন্ধের মধ্য দিয়ে জনগণের আইওয়াশ করছে, যা সমস্যার সমাধান না করে আরও নতুন নতুন সমস্যার জন্ম দিয়ে চলেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়েছে। তারা একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। দেশের সব থেকে নিপীড়িত ও বৈষম্যের শিকার শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান না ঘটিয়ে দেশকে বৈষম্যমুক্ত করা সম্ভব নয়। আমরা প্রত্যাশা করি, হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে কয়েক লক্ষ রিকশা শ্রমিকের রুটি-রুজির ওপর সকল ধরনের বাধা প্রত্যাহার করে বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ ও সবার জন্য বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার কাজকে অগ্রসর করা হবে।
গত ১৯ নভেম্বর বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীর হাইকোর্ট বেঞ্চ ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নেওয়া কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে রুলও জারি করেন আদালত। হাইকোর্টের আদেশের পরদিন থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করছেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা।
আরও পড়ুন— ঢাকা মহানগরে তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ
প্যাডেল চালিত রিকশা সমিতি করা একটি রিটের প্রাথমিক শুনানির পর বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীর হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। স্বরাষ্ট্র সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, আইজিপি, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের আদালতের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।
বুধবার (২০ নভেম্বর) রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ, মিরপুর, কল্যাণপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালকরা।
বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁও, মহাখালী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলী ও ডেমরা এলাকায় জড়ো হন তারা। এতে এসব এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
শুক্রবার (২২ নভেম্বর) দুপুরে জুরাইনে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। এতে আটকা পড়ে নারায়ণগঞ্জ ও নকশিকাঁথা নামে দুটি কমিউটার ট্রেন। এছাড়া বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
শনিবার (২৩ নভেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সাত দফা দাবি বাস্তবায়নে সমাবেশ করেন তারা।
এদিকে, রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন বুধবার (২০ নভেম্বর) এক বিবৃতিতে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।
সেইসঙ্গে আদালতকে ব্যবহার করে শ্রমিকের জীবিকা ধ্বংস না করা ও শ্রমিকদের প্রতিপক্ষ না বানানোর আহ্বান জানান তিনি।
বিবৃতিতে লিপন বলেন, ঢাকা মহানগরের সর্বত্র গণপরিবহন না থাকায় প্রধান সড়ক বাদে বাকি এলাকার মানুষের চলাচলের একমাত্র অবলম্বন রিকশা, ব্যাটারি রিকশা ও ইজিবাইক। ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক সাশ্রয়ী, আরামদায়ক ও পরিবেশবান্ধব এবং চালকের প্যাডেল চালনার কষ্ট লাঘব হওয়ায় এ পরিবহনের চাহিদা ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ঢাকা মহানগরে বর্তমানে প্রায় ৭/৮ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করে। এই পরিবহন বন্ধ হলে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ এক ধাক্কায় বেকার হয়ে পড়বে। উচ্চ দ্রব্যমূল্যের এই বাজারে চালক ও তাদের উপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।