অবশেষে, ২০২৬ সালের নভেম্বরে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো মানবনির্মিত বস্তু পৌঁছাতে যাচ্ছে এক আলোক-দিবস (Light Day) দূরত্বে। আলোক-দিবস বা লাইট-ডে বলতে বোঝায়, আলো এক দিনে যতদূর যেতে পারে, সেই দূরত্ব। সংখ্যায় তা প্রায় ২৫.৯ বিলিয়ন কিলোমিটার। অর্থাৎ আলোকে ওই দূরত্ব অতিক্রম করতে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। আর এই অসাধারণ মাইলফলক স্পর্শ করতে যাচ্ছে ভয়েজার ১ (Voyager 1)।
১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল ভয়েজার ১ মহাকাশযানটি। প্রথমে এর মূল লক্ষ্য ছিল বৃহস্পতি ও শনি গ্রহের ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করা। কিন্তু সফলভাবে সেই কাজ সম্পন্ন করার পর সেখানেই তার মিশনের সমাপ্তি হয়নি, এটি গ্রহমণ্ডলের বাইরেও যাত্রা অব্যাহত রাখে। ধাপে ধাপে এটি অতিক্রম করেছে সৌরজগতের মূল অঞ্চল, পার হয়েছে সূর্যের সূর্যের প্রভাব বলয় বা হেলিওস্ফিয়ার (Heliosphere) এবং অবশেষে প্রবেশ করেছে ইন্টারস্টেলার স্পেসে— অর্থাৎ নক্ষত্রমণ্ডলের মধ্যবর্তী শূন্যতায়।
বর্তমানে ভয়েজার ১ (Voyager 1) পৃথিবী থেকে প্রায় ২৪.৯ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। এর প্রেরিত সংকেত পৃথিবীতে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ২৩ ঘণ্টা ৫ থেকে ১৩ মিনিট। এই যানের গতি প্রায় ৬১,১৯৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা— যা ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছিল কোনো মানুষের তৈরি যানের সর্বোচ্চ গতি। যদিও পরবর্তীতে পার্কার সোলার প্রোব সেই রেকর্ড ভেঙে দেয়।
তবে এখনো ভয়েজার ১ পুরোপুরি সৌরজগত ছাড়িয়ে যায়নি। সৌরজগতের অন্তিম সীমা হিসেবে ধরা হয় ওর্ট ক্লাউডকে (Oort Cloud)। বিজ্ঞানীদের মতে, ওর্ট ক্লাউডে (Oort Cloud) পৌঁছাতে ভয়েজার ১ (Voyager 1)-এর আরও প্রায় ৩০০ বছর লাগবে, আর পুরো অঞ্চল পেরোতে সময় লাগবে প্রায় ৩০,০০০ বছর।
ভয়েজার ১ (Voyager 1)- এর শক্তির উৎস হলো রেডিওআইসোটোপ থার্মোইলেকট্রিক জেনারেটর (RTG), যা প্লুটোনিয়াম-২৩৮ এর তেজস্ক্রিয় ক্ষয় থেকে তাপ উৎপাদনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরি করে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই তেজস্ক্রিয়তা ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় শক্তি উৎপাদনের সক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৭৭ সালে RTG যেখানে ~৪৭০ ওয়াট শক্তি দিত বা বিদ্যুৎ উৎপাদন করত, সেখানে ২০২২ সালের মধ্যে তা কমে এসেছে মাত্র ~২২০ ওয়াটে। প্রতিবছর গড়পড়তায় ৪ ওয়াট করে শক্তি হ্রাস পাচ্ছে।
এ কারণেই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ২০২৬ সালের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিগুলো একে একে বন্ধ করে দিতে হবে। আর ২০৩০ থেকে ২০৩৬ সালের মধ্যে ভয়েজার ১ (Voyager 1) সম্পূর্ণভাবে একেবারেই নিস্ক্রিয় হয়ে যাবে। অর্থাৎ পৃথিবীতে তখন আর কোনো সংকেত পাঠাতে পারবে না।
যদিও ভয়েজার ১ (Voyager 1) এক সময় নিশ্চুপ হয়ে যাবে, তবুও এটি ইতিহাসে থেকে যাবে এক বিস্ময়কর অর্জন হিসেবে। থেকে যাবে ইতিহাসের এক অনন্য সাক্ষ্য। এটি শুধু কেবল একটি মহাকাশযান নয়, বরং মানব সভ্যতার কৌতূহল, অধ্যবসায়, প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির এক প্রতীক।
ভবিষ্যতের কোনো এক দিন, কোনো এক সময়ে যদি কোনো গ্রহান্তরের বুদ্ধিমান প্রাণী ভয়েজার ১ (Voyager 1)-এর “গোল্ডেন রেকর্ড” পড়ে, তাহলে তারা হয়তো আমাদের পৃথিবী ও মানবজাতিকে চিনে নিতে পারবে। তারা হয়তো বুঝতে পারবে, আমাদের পৃথিবী কেমন ছিল—শুধু বিজ্ঞান দিয়ে নয়, বরং অনুভব, সংগীত ও ভাষার নিদর্শনের মাধ্যমে।
