আজ বুধবার, রাজধানী ঢাকার নয়া পল্টনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা’র লক্ষ্যে একটি বিশাল রাজনৈতিক সমাবেশ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তরুণদের রাজনৈতিক অধিকার, অংশগ্রহণ এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই লক্ষ্য পূরণ করতে গিয়ে যদি সাধারণ নাগরিকের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়, তবে সেটি কতটা যৌক্তিক ও জনবান্ধব—সেই প্রশ্নটি নতুন করে উঠে আসে।
রাজধানী ঢাকা এমনিতেই প্রতিদিনের যানজট, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং জনঘনত্বের কারণে এক জটিল শহরে পরিণত হয়েছে। ঈদের আগমুহূর্তে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। মানুষ পরিবার-পরিজনের জন্য কেনাকাটা, প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করা, গ্রামে ফেরার প্রস্তুতি—সবকিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এ সময়টিতে রাস্তা-ঘাট এমনিতেই অস্বাভাবিকভাবে ব্যস্ত ও চাপযুক্ত থাকে। এর মধ্যে সপ্তাহের মাঝামাঝি, অফিসিয়াল একটি কর্মদিবসে, যখন হাজার হাজার মানুষ নিজ নিজ গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তখন এমন একটি বিশাল রাজনৈতিক সমাবেশ আয়োজন করা নগরজীবনের স্বাভাবিক গতিপথকে স্তব্ধ করে পুরোপুরি ছিন্ন করে দিয়েছে।
আজ সকাল ৯টার দিকে বিজয় সরণি থেকে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, মগবাজার, মালিবাগ এবং পল্টন—সর্বত্রই অসহনীয় যানজট দেখা যায়। এতে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কগুলোতে যান চলাচল কার্যত অচল হয়ে পড়ে। যাত্রীবাহী বাস, অ্যাম্বুলেন্স, ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা রাইডশেয়ার—সব কিছু আটকে পড়ে লম্বা সারিতে। অনেকে অফিসে পৌঁছাতে পারেননি, অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থেকেছেন। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, হাসপাতালে যাচ্ছেন এমন রোগীরা, শিক্ষার্থী কিংবা শিশু-কিশোরদের নিয়েও মানুষকে দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হেঁটেই অনেকটা পথ অতিক্রম করেছেন।
ফার্মগেট ট্রাফিক পুলিশ বক্সের এক সদস্য জানালেন, “এই জ্যাম শাহবাগ পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।” কারওয়ান বাজারের পাশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতেও ছিল যানবাহনের দীর্ঘ সারি। অনেক যাত্রী হাঁটতে বাধ্য হন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সরওয়ার একটি গণমাধ্যমকে বলেন, “আজ ছাত্রদল ও যুবদলের তারুণ্যের সমাবেশ রয়েছে। কয়েক লাখ লোক গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা ও আশপাশের এলাকা থেকে এসেছে। এতে নগরীর প্রায় সব এলাকায় যানজট তৈরি হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, জামায়াতের নেতা আজহারুল ইসলামের মুক্তির পর শাহবাগে জমায়েত শুরু হয়, সেখান থেকেই যানজটের সূচনা হয়।
মগবাজারে এক বেসরকারি চাকরিজীবী নাদিম মাহমুদ বলেন, “সকালে শাহবাগে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন মগবাজারে এসেছি, এখানেও রিকশা পর্যন্ত নড়ে না।”
এই পরিস্থিতি থেকে একটি মৌলিক প্রশ্ন ওঠে আসে—এই সমাবেশ কি শুক্রবার বা শনিবারে আয়োজন করা যেতো না? শুক্রবার বা শনিবার আমাদের দেশে সরকারি ছুটির দিন, তখন রাজধানীর যানচাপ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনাও থাকে অনেকাংশে সীমিত। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনগণের প্রত্যাশা কেবল তাদের নিজেদের কর্মসূচি সফল করাই নয়—বরং সেই কর্মসূচি যেন সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, সেটি নিশ্চিত করাও তাদের দায়িত্ব।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক মতপ্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত। একইভাবে, নাগরিকদের মুক্তভাবে চলাফেরা, নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানো এবং নিরবচ্ছিন্ন নাগরিক সেবা পাওয়ার অধিকারও সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। যখন একটি অধিকার আরেকটি অধিকারের ওপর ছাপিয়ে যায় এবং সাধারণ জনগণের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা জনমনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং রাজনৈতিক উদ্যোগের মূল লক্ষ্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাদের কর্মসূচি এমনভাবে গ্রহণ করে, যাতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয় না বরং জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়, তবে তারা জনগণের আস্থা ও সমর্থন আরও বেশি অর্জন করতে পারে। তরুণদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনমতের সমর্থন পেতে হলে প্রথমেই সাধারণ মানুষের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতির মনোভাব দেখাতে হবে। জনদুর্ভোগের মাঝ দিয়ে কখনোই ইতিবাচক রাজনৈতিক বার্তা প্রতিষ্ঠিত হয় না।
রাজনীতির মাধ্যমে যদি জনভোগান্তির পরিবর্তে জনসচেতনতা বাড়ে, তবে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের আস্থা ও সমর্থন আরও বেশি পাবে। তরুণদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা যেন নাগরিক জীবনযাত্রাকে জিম্মি করে না তোলে। এমনকি রাজধানীর প্রতিটি মোড়, প্রতিটি টাওয়ার, প্রতিটি পোস্টার যদি রাজনীতির প্রচারে সয়লাব হয়, আর তার সঙ্গে যদি যানজটের নিদারুণ চিত্র জুড়ে যায়—তবে জনগণের মনে রাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাই বদ্ধমূল হবে।
রাজধানীর প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি মোড়, প্রতিটি টাওয়ার—যেখানে রাজনৈতিক প্রচারণা পৌঁছে, সেখানে যদি ভোগান্তিও পৌঁছায়, তাহলে সাধারণ মানুষ রাজনীতিকে সমস্যার উৎস হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। এটি দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণে তরুণদের আগ্রহের ক্ষেত্রেও এক ধরনের নিরুৎসাহ তৈরি করে।
সুতরাং, রাজনৈতিক দলের প্রতি এই আহ্বান রইল—তারা যেন সময়, স্থান এবং প্রেক্ষাপটের গুরুত্ব বুঝে কর্মসূচি নেয়। গণতন্ত্রের বিকাশ হোক, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি গড়ে উঠুক, তবে সেটি যেন নাগরিকদের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে হয়, তাদের কষ্ট দিয়ে নয়। জনগণই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু—তাদের অংশগ্রহণ, না যে দুর্ভোগ, হোক রাজনৈতিক সফলতার আসল মানদণ্ড।
আমরা চাই তারুণ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি জোরদার হোক, গণতন্ত্র আরও গভীর হোক—তবে সেটি যেন কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার বাধা না হয়। কারণ, জনগণই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু, তাদের দুর্ভোগ নয়—তাদের আস্থা ও অংশগ্রহণই হোক রাজনৈতিক সফলতার মূল মানদণ্ড।
