বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গত বৃহস্পতিবার (৩ এপ্রিল) ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (৭ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বর্ধিত শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করা এবং মার্কিন পণ্য বেশি পরিমাণে আমদানির বিষয়ে আলোচনার জন্য চিঠি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে এই আলোচনা এপ্রিল মাসেই শুরু করতে চায় বাংলাদেশ বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, ‘নতুন শুল্ক আরোপের প্রভাব কী হতে পারে, সেটি আমরা মূল্যায়ন করছি। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা।’
কবে নাগাদ আলোচনা শুরু হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার চিঠি হস্তান্তরের পরপরই আমরা আলোচনা শুরু করার জন্য তাদের কাছে সময় চাইবো। আমরা চাইবো, এপ্রিলের মধ্যেই তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে।’
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার (এপ্রিল) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ ছাড়াও চীনের ওপর ৪৬ শতাংশ, ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কার ওপর ৪৪ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ওপর ২৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
গত অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করেছে ৮৪০ কোটি ডলারের পণ্য এবং আমদানি করেছে ২২০ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২০ কোটি ডলার। এই বাণিজ্য ঘাটতিকে বাংলাদেশের মোট রফতানি দিয়ে ভাগ দিলে— অর্থাৎ ৬২০ কে ৮৪০ দিয়ে ভাগ দিলে ৭৪ শতাংশ দাঁড়ায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর অর্ধেক শুল্ক আরোপ করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মার্কিন পণ্যের ওপর বাংলাদেশ কত শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, সেটি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এখানে শুধুমাত্র বাণিজ্য ঘাটতিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।’
আরেকজন কর্মকর্তা জানান যে, মোট ২২০ কোটি ডলারের আমদানির মধ্যে ১২০ কোটি ডলার পণ্যের ওপর কোনও শুল্ক নেই। এরমধ্যে রয়েছে তুলা, গমসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। ৪০ কোটি ডলার পণ্যের ওপর ৪ থেকে ৬ শতাংশ শুল্ক দেওয়া হয়েছে। বাকি পণ্যের ওপর শুল্ক বেশি।
তিনি বলেন, ‘শুল্ক বেশি এ ধরনের পণ্যের মধ্যে রয়েছে গাড়ি, মদসহ এ ধরনের পণ্য।’
আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র পণ্যের হিসাব করেছে। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের সেবা রফতানি করে তারা বছরে প্রচুর অর্থ বাংলাদেশ থেকে আয় করে। সেটি তারা বিবেচনায় নেয়নি।’
অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম হচ্ছে শুল্ক আরোপ করা হলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে এবং চূড়ান্ত ভোক্তাকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে। ধরা যাক, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা ১০০ ডলারের একটি পণ্যে ১৬ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়েছে এবং ভোক্তা সেটি ১১৬ ডলারে কিনেছে। এখন সেটি যদি ৩৭ শতাংশ করা হয়, তবে ওই পণ্যের দাম বেড়ে দাঁড়াবে ১৩৭ ডলার এবং ওই দাম আমেরিকান ভোক্তাকে পরিশোধ করতে হবে। মার্কিন ভোক্তাকে বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের লাভ কী, সেটি অনেকের কাছে প্রশ্ন।
এ বিষয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা যে ধারণা পেয়েছি, সেটি হচ্ছে— তারা তাদের রফতানি বাড়াতে চায়। কিন্তু এটি অনেক দেশের পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না। কারণ তাদের সেই পরিমাণ অর্থ নেই।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়টি কতদিন ধরে রাখতে পারে, সেটি এখন দেখার বিষয়।’
ট্রাম্প সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলো সরকার। এজন্য গত ২০ জানুয়ারি ট্রাম্প শপথ গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যে মার্কিন কোম্পানি আর্জেন্টের সঙ্গে এলএনজি ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তি করে সরকার। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্টারলিংকের বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করার বিষয়েও একমত হয় সরকার। এছাড়া তুলা, গম, সয়াবিন, স্ক্র্যাপ মেটালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি কীভাবে বাড়ানো যায়, সেটি নিয়েও চিন্তাভাবনা চলছিল।
এ বিষয়ে সরকারের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা গম আমদানি করে থাকি রাশিয়া, ইউক্রেন ও কানাডা থেকে। এখন কানাডা থেকে আমদানি না করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করার বিষয়টি বিবেচনা করা যায়। আবার সয়াবিন আনা হয় ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা থেকে। তার কিছু অংশ আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে করতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘তবে এখানে মূল বিষয় হচ্ছে— আমদানি সরকার করে না, করে বেসরকারি খাত। তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির জন্য।’
