ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে মার্চ-এপ্রিল দুই মাস ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়ার ১৯০ কিলোমিটার এলাকাসহ দেশের পাঁচটি ইলিশের অভয়াশ্রমে সব ধরনের মাছ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। ফলে ভোলার সাত উপজেলার প্রায় দুই লক্ষাধিক জেলে কর্মহীন হয়ে পড়বেন। নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ঋণের কিস্তি পরিশোধের চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।
জেলেদের দাবি, এই দুই মাস কিস্তির চাপ বন্ধ করতে হবে, নইলে তারা ভয়াবহ সংকটে পড়বেন। নিষেধাজ্ঞার শুরুতে সরকার প্রতিটি পরিবারকে ৪০ কেজি চাল বরাদ্দ দিলেও জেলেরা বলছেন, চালের সঙ্গে ডাল, তেল এবং নগদ অর্থ সহায়তা দিতে হবে। এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার তাদের দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন।
জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞাটি ২৮ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা থেকে কার্যকর হবে এবং চলবে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে ভোলার মেঘনা নদীর চর ইলিশা থেকে চর পিয়াল পর্যন্ত ৯০ কিলোমিটার এবং তেঁতুলিয়া নদীর চর ভেদুরিয়া থেকে চর রুস্তম পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার জুড়ে সব ধরনের মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। জেলেদের জন্য এ সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন বড় আর্থিক সংকট তৈরি করবে, অন্যদিকে ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ তাদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভোলা জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলার মোট নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজার ২৮৩ জন। তাদের মধ্যে ৮৯ হাজার ৬০০ জেলে পরিবার নিষেধাজ্ঞার সময় সরকারি ত্রাণ পাবে। সরকার ৪০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দিলেও জেলেরা বলছেন, এটি কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়।
তথ্য আরও বলছে, জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজার ২৮৩ জন হলেও এর মধ্যে ভোলা সদর উপজেলায় জেলে রয়েছেন ২২ হাজার ৪১২ জন, দৌলতখানে ২৪ হাজার ৩ জন, বোরহানউদ্দিনে ১৯ হাজার ৮৩৮ জন, তজুমদ্দিনে ১৯ হাজার ৫৭২ জন, লালমোহনে ২৪ হাজার ৮০৬ জন, চরফ্যাশনে ৪৪ হাজার ৩১১ জন ও মনপুরা উপজেলায় নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন ১৫ হাজার ৩৪১ জন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অধিকাংশ জেলে তাদের ট্রলার ও জাল নদী তীরে তুলে রেখেছেন। কেউ কেউ শেষ মুহূর্তে মাছ ধরার চেষ্টা করছেন, কারণ আগামী দুই মাস তারা আয়হীন হয়ে পড়বেন।
ভোলা সদর উপজেলার ভেলুমিয়া পাকার মাথা, ইলিশা চডার মাথা, তুলাতুলি, ভোলার খাল। দৌলতখান উপজেলার ভবানীপুর, তজুমদ্দিনের স্লুইসগেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ইলিশের অভয়াশ্রমে মাছ শিকারের সরকার ঘোষিত ২ মাসের নিষেধাজ্ঞা মেনে ইতোমধ্যে অধিকাংশ জেলেরা তাদের জাল-ট্রলার নদী তীরে, বিভিন্ন খালে ও প্রত্যেকে যে যার সুবিধামত নিরাপদ স্থানে উঠিয়ে রেখেছেন। অন্যান্য জেলেরাও প্রস্তুতি নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ শেষ সময়ে নদীতে মাছ শিকারে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
ভেলুমিয়া এলাকার নুর ইসলাম মাঝি বলেন, “কিস্তির টাকা কই পাই? সরকার যদি কিস্তি বন্ধ না করে, তাহলে আমাদের নদীতে নামতে হবে। আর নদীতে নামলেই পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। কিস্তির জন্য পালিয়ে থাকতে হবে!”
মিজান মাঝি বলেন, “৪০ কেজি চাল দিয়ে কী হবে? শুধু ভাত তো খাওয়া যায় না। সরকার যদি নগদ টাকা বা অন্য সহায়তা দিত, তাহলে অন্তত চলতে পারতাম। কিন্তু এখন আমাদের সামনে শুধু দুশ্চিন্তা আর দেনার বোঝা।”
ভোলার খাল এলাকার মো. শাকিল, মো. রফিক সহ আরও অনেক মাঝি জানান, দুই মাসের অভিযানের কারণে তারা নদীতে মাছ ধরতে যেতে পারবেন না। ফলে রোজগার বন্ধ থাকবে, সমিতি (ঋণের কিস্তি) চালাতে পারবেন না তারা। তাই অভিযানের দুইমাস যদি সরকার ঋণের কিস্তি বন্ধ করে তাহলে তাদের জন্য অনেক ভালো হবে বলেও জানান তারা।
তারা আরও জানান, যদি এই ঋণ বন্ধ না করা হয় তাহলে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই তাদেরকে বাধ্য হয়ে নদীতে মাছ ধরতে যেতে হবে।
“নদীতে গেলে আবার প্রশাসনে আমাদের জাল-ট্রলারসহ ধরে নিয়ে যায়। সরকার সমিতির কিস্তি না বন্ধ করলে সমিতির চাপে আমাদের পলাইতে হইব। খেয়ে না খেয়ে বাড়িতে থাকা যায়, কিন্তু সমিতির কিস্তি না দিয়ে থাকা যায় না।”
এ বিষয়ে ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, “জেলেদের জন্য ৭ হাজার ১৬৮ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা প্রথম ১০ দিনের মধ্যে বিতরণ করা হবে। পাশাপাশি কিস্তির চাপ কমানোর জন্যও চেষ্টা করা হবে। নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালানোসহ সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।”
২ মাসের নিষেধাজ্ঞাকালীন সরকারিভাবে জেলেদের চালের সঙ্গে ডাল-তেল দেওয়ার দাবিতেও একাত্মতা প্রকাশ করে সম্প্রতি ভোলার মনপুরা উপজেলায় জেলেদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, “আমরা চেষ্টা করছি ২৫ কেজি চাল যেটা দেওয়া হত সেটা ৪০ কেজি করা এবং ৪০ কেজি যেটা দেওয়া হত সেটি ৫০ কেজি করা। কারণ একটা পরিবারে যদি ৪-৫ জন সদস্য থাকে তাহলে এ চাল তাদের হয় না। আমরা শিকার করছি চালের পরিমাণ একেবারেই কম। যেহেতু তাদের আর্থিক আয়ের কোনো ব্যবস্থা থাকে না। তাহলে তারা কি দিয়ে ভাত খাবে? চালের সঙ্গে ডাল-তেল দেওয়ার চেষ্টা করব। কারণ দুই মাস কোনো আয় না থাকলে, কিস্তির চাপ থাকলে, জেলেরা কীভাবে বাঁচবে? জেলেদের এ দাবিটা ন্যায্য দাবি।”
এদিকে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভোলার ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৮৫ হাজার টন নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে জেলেরা বলছেন, “ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকার নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে, কিন্তু আমাদের টিকে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই! কিস্তির জন্য পালিয়ে থাকব, না খেয়ে থাকব, না কি নদীতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ব—এটাই এখন আমাদের বড় প্রশ্ন।”
অপরদিকে, ইলিশের বাড়ি ভোলায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার টন। এ বছরেও ইলিশের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা ভোলা জেলা মৎস্য বিভাগের।
